নামমাত্র কাজে প্রকল্পের টাকা লুট

জরুরি মেরামতের নামে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ তালিকায় রেখে তৈরি করা হয়েছে প্রকল্পের নকশা। এরপর উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি (ওটিএম) অবলম্বন না করে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের দিয়ে বেড়িবাঁধে নামমাত্র সংস্কারের কাজ করিয়ে লুট করা হয়েছে প্রকল্পের টাকা।

খুলনার উপকূলীয় কয়রা উপজেলার দুই পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ ও শাকবাড়িয়া নদী। ক্রমাগত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর নদীর পানিতে প্লাবিত হয় সেখানকার হাজার হাজার বসতি। লবণাক্ত পানি থেকে লোকালয়কে রক্ষা করতে সেখানে নদীর পাড়ে রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, যা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের (পওর) দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

স্থানীয়রা জানান, বেড়িবাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রত্যেক বছরই কোনো না কোনো প্রকল্প নেয় পাউবো। কাগজ-কলমে প্রকল্পের কাজও হয়, তবে জলোচ্ছ্বাস হলে ওই সব বাঁধ আর টিকে থাকে না। চলতি অর্থবছরেও একইভাবে নতুন বাঁধ মেরামতের জন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে নামমাত্র কাজ করে পাউবো ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই টাকা লুট করে নিচ্ছে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম ও সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, ‘বিগত ১০ বছরে জরুরি কাজের নামে কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি। সেই সব জোড়াতালিতেও বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে জনগণের অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। এ বছরও তাই-ই হচ্ছে।’

অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বেড়িবাঁধ জরুরি সংস্কারের নামে পাউবো প্রথমে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে। তবে সেই সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁধ মেরামতের কাজ না করে অর্ধেক মূল্যে স্থানীয় সাব-ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। সাব-ঠিকাদাররাও সেই কাজ না করে চুক্তিবদ্ধ হওয়া মূল্যের অর্ধেক মূল্যে শ্রমিক সর্দারদের মৌখিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। সর্দাররা স্থানীয় শ্রমিকদের মাধ্যমেই সেই কাজ করিয়েও লাভবান হন। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে প্রকল্পের মূল টাকার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় হয় বাঁধ মেরামতে। বাকি টাকা চলে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। যার অংশ পাউবো কর্মকর্তারাও পান।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে খুলনার কয়রা উপজেলার দুটি পোল্ডারে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তারা ১৮টি স্থান নির্ধারণ করেছিল, যা মেরামতের জন্য নকশা এবং কাজের প্রাক্কলনও তৈরি করেছিলেন পাউবোর প্রকৌশলীরা। এতে সরকার বরাদ্দ দিয়েছিল ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা। এ কাজের জন্য কোনো প্রকার দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে সরাসরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি স্থানের কাজ দেয়া হয়েছে যশোর জেলার কেশবপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তানিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুল মতিনকে। বাকি ছয়টি স্থানের মধ্যে চারটি স্থানীয় ঠিকাদার মোজাফ্‌ফর হোসেন এবং অন্য দুটি স্থানের কাজ করেছেন সিরাজউদ্দৌলা ও খলিলুর রহমান নামে দুজন ঠিকাদার।

সম্প্রতি ওই সব এলাকা পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চোরামুখা এলাকায় বেড়িবাঁধের চারটি স্থানে কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি, চারটি স্থানে ১ হাজার ২০ মিটার বাঁধে রিং-ডাইক ও অস্থায়ী ঢাল সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে। এর জন্য বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। তবে ওই কাজ শ্রমিক সর্দাররা মাত্র ২০ লাখ টাকায় শেষ করেছেন বলে এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, চারটি স্থানের মধ্যে দুটিতে কোনো মাটির কাজই হয়নি। সামান্য কিছু জিও ব্যাগ বালু ভর্তি করে বাঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

কাজের ঠিকাদার ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোজাফ্‌ফর হোসেন দাবি করেন, পাউবোর ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে।

এত কম টাকায় কাজ শেষ করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি পাউবোকেই দোষারোপ করেন। বলেন, ‘পাউবো তো সব কাজ তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে করিয়েছে। আমি মাত্র চারটি কাজ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি। সব ঘাপলা তো ওই ঠিকাদারের (আব্দুল মতিন) পরামর্শে হয়েছে।’

উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হরিহরপুর এলাকায়ও চলছে এই প্রকল্পের কাজ। সেখানে দেখা গেছে, বাঁধের ঢালে সিমেন্টের ব্লকের ওপর কিছু জিও ব্যাগ সাজিয়ে রেখে কাজ শেষ দেখানো হয়েছে।

ওই গ্রামের বাসিন্দা চারু মণ্ডল বলেন, ‘এখানে কয়েক দিন আগে বাঁধ নির্মাণের কাজ হয়েছে। এখন এই কাজের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। টাকা লুটপাট করতে নামসর্বস্ব কাজ দেখানো হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল ঠিকাদারের হয়ে কাজটি করেছেন অহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী কাজ করেছি। কোথায় কাজ করতে হবে আর হবে না, এটা পাউবো বুঝবে।’

এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মেদেরচর এলাকায় ৪০০ মিটার বাঁধের মাটির কাজ কিছুটা করেই ফেলে রাখা হয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী দুই পাশের ঢালে মাটি ভরাট করার পর বাঁধ উঁচু করার কথা। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মূল বাঁধের দুই পাশের মাটি ছেঁটে ওপরে তুলে বাঁধ উঁচু করছিল। এতে বাঁধ আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই স্থানীয়রা বাঁধা দিয়েছিলেন।’

এই কাজটিরও দায়িত্বে রয়েছেন সাব-ঠিকাদার অহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী কাজ করছিলাম। কিন্তু তা এলাকার মানুষের পছন্দ হয়নি। তাই আপাতত কাজ বন্ধ আছে।’

কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা এলাকায় ১৩০ মিটার রিং-ডাইক নির্মাণকাজের ঠিকাদার শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন। তিনি বলেন, ‘আমার কাজটিতে ২৭ লাখ ৪১ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। পাউবোর প্রাক্কলন ও নকশা অনুযায়ী কাজ করে বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অধিকাংশ স্থানে মূল বাঁধের হিসাব ধরে প্রাক্কলন ও নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। ফলে ঠিকাদাররা পুরোনো বাঁধের ওপর যৎসামান্য মাটি দিয়ে এর ঢাল ছেঁটে সেখানে জিও ব্যাগ স্থাপন করেছেন। দেখলে মনে হবে বাঁধের কাজ নতুন করা হয়েছে।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গণেশ মণ্ডল বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশে শাকবাড়িয়া ও গাতিরঘেরি এলাকার তিনটি স্থানে নিম্নমানের কাজ হয়েছে। ঠিকাদারের লোকজন দুটি খননযন্ত্র দিয়ে ঢালের মাটি কেটে বাঁধ উঁচু করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী ১০০ মিটার দূর থেকে মাটি এনে বাঁধের ঢাল ও উচ্চতা বাড়ানোর কথা। কিন্তু খরচ বাঁচাতে তারা দায়সারা কাজ করেছেন।’

তিনি দাবি করে বলেন, ‘শ্রমিকদের দেয়া তথ্য এবং আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ৭৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দের ওই তিনটি স্থানের কাজ ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় শেষ করা হয়েছে।’

নাম না প্রকাশ করার শর্ত পাউবোর এক উপপ্রকৌশলী বলেন, ‘জরুরি ভিত্তিতে সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগ দেয়ার একটি বিধান রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রকল্পের টাকা তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি ধরে পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। আর ঠিকাদার যেহেতু অসাধু কর্মকর্তাদের কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পান, তাই কাজের মান ভালো হয় না।’

খুলনার কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের (পওর) দায়িত্বে রয়েছে সাতক্ষীরার পানি উন্নয়ন বোর্ড-২।

ওই অফিসের কয়রা অঞ্চলটি দেখাশোনা করেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সুমন শিকদার। তিনি বলেন, ‘আগের অর্থবছরের কাজগুলোতে প্রাক্কলন ও নকশায় ত্রুটি থাকতে পারে। চলমান অর্থবছরের কাজে ওই সমস্যা নেই। আমরা চেষ্টা করছি আগের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে। এখন যেভাবে নকশা ও প্রাক্কলন তৈরি হবে, তা বরাদ্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *